Wednesday, June 26, 2019

নজরুল: লড়াইয়ের কবি–ভালোবাসার কবি – সুজয় কর্মকার


নজরুল কাব্যের আসল কথা হল লড়াই, বিদ্রোহ। দ্বিতীয় হল ভালোবাসা। বিংশ শতাব্দীর তরুণদের মধ্যে তিনিই হচ্ছেন প্রথম কবি, বরীন্দ্রনাথের যশোমন্ডলের মধ্যে থেকেও যিনি খুজে পেয়েছেন স্বকীয় রচনাভঙ্গী এবং দৃষ্টিভঙ্গী।
ধূমকেতুর মতই তাঁর আবির্ভাব। সাহিত্য সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি যেন কলবোশেখীর ঝড়। প্রথম মহাযুদ্ধে নজরুল ইউনিফর্ম পরে সৈনিকের ব্রত গ্রহণ করেছিলেন পরে ইউনিফর্ম খুলে ফেললেও সৈনিকের ব্রত নিয়েই সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রবেশ করছিলেন। তিনি ছিলেন ঝর্ণার মত উচ্ছ্বল, দামিনীর মত চঞ্চল। তারুন্য ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এক আবেগ। আত্মশক্তিতে বলীয়ান-
“আমি সহসা আমারে চিনেছি,আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।”
কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার ভাব, ভাষা ও নৃত্য-পাগল ছন্দে আলোড়িত হল বাঙালীর হৃদয়। বিদ্রোহী’র ‘আমি’ শুধুমাত্র লেখক নন- যিনি পড়ছেন অর্থাৎ প্রত্যেক পাঠক। এই দৃষ্টিভঙ্গী এই জীবন-দর্শন, মানবমাত্রের এই বিদ্রোহী মূর্তি আগে বাংলা কাব্যে আত্মপ্রকাশ করেনি। বিদ্রোহের এই দৃশ্যময়, ধ্বনিময় ও আবেগময় প্রকাশের কারণেই বাংলা সাহিত্যে নজরুল “বিদ্রোহী” কবি –সেইসঙ্গে যুগ-প্রবর্তক কবি।
তাঁর বিদ্রোহ কেবল দেশের রক্ত শোষক জাতির বিরুদ্ধে নয়, তাঁর বিদ্রোহ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অসত্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে, ছুঁৎমার্গী সমাজপতিদের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় ভন্ডামীর বিরুদ্ধে -এক কথায় সকল শ্রেনীর অনাচারী দুষ্কৃতকারীদের বিরদ্ধে। তাই গদ্যে পদ্যে তাঁর হাতে বেজে উঠল ‘অগ্নিবীণা’।
নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা বাঙ্গালীর চেতনায় এনেছিল জোয়ার। শুনিয়েছিল শিকল ভাঙার গান। ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’ ‘,ভাঙার গান’, সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণিমনসা’, ‘প্রলয়শিখা’, ‘সন্ধ্যা’ ও ‘সওগাত’-প্রভৃতি কাব্য-গ্রন্থে তাঁর বিপ্লব-নিষ্ঠা মূর্ত হয়ে আছে। চাই অভিযান, চাই রদবদল, চাই বাধা-বিঘ্নের সাথে বিরোধ, চাই বর্তমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। চাই মরণ -দোল, চাই ঝড়ের সঙ্গে লড়াই- এক কথায় মানুষকে জাগানোই হল নজরুলের বিপ্লব-নিষ্ঠার মূল কথা।
রাজরোষ তাঁকে ক্ষমা করেনি। তাঁর স্থান হয় বন্দীশালায়। অগ্নিবীনা’ ছাড়াও কবির পাঁচটি বই, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’, চন্দ্রবিন্দু’, ‘ প্রলয় শিখা’ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ হয়। তবুও তাঁকে দমানো যায় নি। তাঁর কবিতার শরীর জুড়েছিল যৌবনধর্মী আবেগ এবং জীবনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা। তিনি ছিলেন ন্যায় ও সত্যের সাধক-এককথায় উৎপীড়িতের কবি। তাই কবির সোচ্চার ঘোষণা –
“আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতেন ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না–
অত্যাচারীর খড়্গকৃপান ভীম রণভূমে রণিবে না..
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।”
কিংবা-
“মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য”.।
শুধু সাহিত্যে নয় নজরুল ছিলেন স্বভাবেও বিদ্রোহী। তাঁর এই বিদ্রোহী চেতনার মুলে ছিল মানবপ্রেম ও মানব -নিষ্ঠা। নজরুলের কল্পনায় ভগবানের চেয়ে মানুষ বড়। মানবিকতাই তাঁর ধর্ম। নজরুলের কাব্যে তাই মানুষেরই জয়গান। শোনা গেছে সাম্যবাদের সুর। তবে এ সাম্যবাদে সোসালিজম-কম্যুনিজমের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানুষের কথা–
“গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।”
****************
“তুমি আমায় ভালোবাস, তাইতো আমি কবি…”
আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।।”
অগ্নিতাপস এই বিদ্রোহী কবির জীবনেও ফুটেছিল ভালোবাসার অনেক ফুল। প্রেম -প্রীতি রাগ-অনুরাগ আর সুখ-দুঃখের বিচিত্র ধারায় বয়ে গেছে তাঁর জীবন। ‘বুলবুল’, ‘ছায়ানট’ আর ‘দোলন চাঁপা’ এই তিনটি বইয়ের অনেক কিছুই ভালোবাসাবাসির খেলা। এই কবি খোলাখুলি ভালোবাসার গান লিখেছেন আর গেয়েছেন। ভালোবাসার সাহিত্যে নজরুলের স্থান খুব উুঁচুতে।
নজরুলের প্রেমের কবিতাও সোজাসুজি বস্তু নিষ্ঠ। হৃদয়শীল সত্যনিষ্ঠা এর প্রান। রূপ- -রস-গন্ধ-স্পর্শ- শব্দ কোন কিছুর অভাব নেই।
“আমার দ্বারের কাছটিতে তার
ফুটতো লালী গালের টোলে,
টলতো চরণ, চাউনি বিবশ
কাঁপতো নয়ন পাতার কোলে।”
লড়াইয়ের বীর প্রেমের বীর হতে পারে না। তাকে ভালোবাসার জগতে হারতেই হয়। ভালোবাসায় মানুষ হারে, হেরে ছটফট করে-
“হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে!
আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে।…”
হৃদয়ের জগতে নেই হাম-বড়ামি। চাই এখানে নম্রতা, আমিত্বের ধ্বংস সাধন–
” আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
(আজ) বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল।”
ভালোবাসা কবিকে যেমন ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে’মাতিয়ে রেখেছিল তেমনি ভালোবাসাই আবার তাঁর মনকে করেছিল ব্যথাতুর। হৃদয়কে করেছিল ক্ষতবিক্ষত,রক্তাক্ত। ব্যথার বিষে তিনি হয়েছিলেন’নীলকণ্ঠ কবি। প্রেমের যত ভাবাবেগ,ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া,ঈর্ষা,অবহেলা বিস্মৃতি -সবকিছু কবি উপলব্ধি করেছেন। সেইসব আঘাত প্রত্যাঘাত কবি ভাষায়, ছন্দে ফুটিয়ে তুলেছেন। সকরুণ বেদনায় কবি বলেন-

“করেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হতে মোর,
ভেবেছিলাম গাঁথব মালা -পাইনি খুজে ডোর…”
পরবর্তী জীবনে অন্য সার্থক প্রেম ধরা দিলেও কবির প্রথম প্রেমের নায়িকা অধরা..
“তুমি মোরে ভুলিয়াছ, তাই সত্য হোক
নিশি শেষে নিভে গেছে দীপালি-আলোক”।
অধরা মানসীর জন্য হাহাকার শোনা গেছে তাঁর কবিতায়-
“দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন রোল।
কূল মেলেনা তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ দোল! ”
কবি ভুলতে পারেন না সেই কিশোরী কন্যাকে। তাই বিষাদ-ক্লিষ্ট হৃদয়ে গেয়ে ওঠেন-
“রহি রহি কেন সেই মুখ পড়ে মনে…”
নজরুল সুরের কবি। নজরুল গানের কবি। নজরুল গায়ক কবি। বাঙালীকে গজল শুনিয়ে নজরুল নামজাদা। সুর ছন্দ ও কথার মাধ্যমে নজরুল পৌছে গেছেন জনগণ হদয়ে-সেখানে চিরকাল তাঁর স্থিতি।
“বাগিচায় বুলবুলি তইু ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল”, ” চেও না সুনয়না আর চেও না , এ নয়ন পানে”, “এত জল ও কাজল চোখে, পাষানী আনলে বল কে?”-তাঁর গজলের প্রেমের দুলকি চালে বাঙালী হল মাতোয়ারা!
তারপর?
তারপর সব গান থেমে গেল। গানের পাখি নীরব হল। কণ্ঠ রুদ্ধ হল কবির। স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেল জন্মভূমি চুরুলিয়া, তাঁর শৈশব, কৈশোর, চায়ের দোকানের কাজ, লেটোর দলে গান করা গান লেখা, শিয়ারশোল স্কুলের স্মৃতি, বন্ধু শৈলজানন্দের সাথে কৈশোরের সেই উত্তাল দিনগুলি, পরিক্ষা না দিয়েই পালিয়ে গিয়ে বাঙালী পল্টনে যোগদান। ভুলে গেলেন গোমতীর তীরে ফেলে আসা সেই কিশোরী কন্যার কথা,ভুলে গেলেন আত্মীয় -পরিজন -সংসার। ভুলে গেলেন চিরসঙ্গী দুলীকে -সে কাছে থেকেও অনেক দুরে। বিস্মরণের অতলে তলিয়ে গেল বন্ধুবান্ধব, অসংখ্য অনুরাগী-অনুরাগিনীর। রইল শুধু সম্বিৎহারা কবির শূন্য, উদাস বোবা দৃষ্টি।
“চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়…”
নিজের লেখা গানের কথা এভাবে যে নির্মম সত্য হয়ে দেখা দিল কবির জীবনে – তা কে ভেবেছিল! কবি যেমন প্রচুর আয় করেছেন তেমনি বে হিসাবী খরচও করেছেন। শেষের দিকে দারিদ্রের চরম লাঞ্ছনায় মাত্র চার হাজার টাকার জন্য তাঁকে তাঁর গানের রয়ালটি সহ সমস্ত রচনার স্বত্ব বন্ধক দিতে হয়। তার উপর প্রিয় পত্নীর অসুস্থতা কবিকে দিশেহারা করে দেয়। ১৯৪২ সালের ৯ই জুলাই কলকাতা বেতার কেন্দ্রের এক গল্পপাাঠের অনুষ্ঠানে পাঠ শেষ করার আগেই জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে কবির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে এবং তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
তারপর সে এক যন্ত্রনার, করুণ বেদনার ইতিহাস। কান্না পাওয়ার ইতিহাস। অনেক চেষ্টা হল। দেশে বিদেশে তাঁর চিকিৎসা হল। কিন্তু ব্যর্থ হল সব প্রচেষ্টা। প্রায় তিন যুগ ঐরকম অবস্থায় থাকার পর ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগষ্ট ঢাকায় সংসারের সমস্ত কোলাহল থেকে দুরে… অনেক দুরে… ঘুমের রাজ্যে নীরব কবি শ্রান্ত হয়ে চিরঘুমে ঘুমিয়ে পড়লেন।

No comments:

Post a Comment

মুসলিম উম্মাহ্‌র অধঃপতনে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা

"এক জাতি, এক ভূমি"- এই চেতনা ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে একদা যে মুসলিম উম্মাহ্‌ পরিণত হয়েছিল বিশ্বের প্রভাবশালী সভ্যতায় সেই একই ...

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ